সাংবাদিক-লেখক মনজুর আহমদকে নিয়ে সাহিত্য একাডেমির ভিন্নমাত্রার আয়োজন


প্রকাশিত: ৭ জানুয়ারি ২০২৪, ০৫:০১
...
‘সাহিত্য একাডেমি, নিউইয়র্কের মাসিক সাহিত্য আসর ২৯ ডিসেম্বর শুক্রবার জ্যাকসন হাইটসের জুইস সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরিচালনায় ছিলেন একাডেমির পরিচালক মোশাররফ হোসেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকলের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানানো হয়। পারভীন সুলতানার বিজয়ের কবিতা আবৃত্তির মধ্য দিয়ে আসরের সূচনা হয়। এবারের আসরটি দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম পর্বটি ছিল লেখকের সঙ্গে মুখোমুখি কথোপকথন। পর্বটি পরিচালনায় ছিলেন লেখক হাসান ফেরদৌস। তিনি বরেণ্য সাংবাদিক ও লেখক মনজুর আহমেদের সঙ্গে তাঁর সাংবাদিকতা এবং লেখালেখি নিয়ে কথা বলেন। দ্বিতীয় পর্বটি সাজানো হয় সাহিত্য একাডেমির নিয়মিত আয়োজন আলোচনা ও স্বরচিত পাঠ দিয়ে।

আলোচনার শুরুতে হাসান ফেরদৌস বলেন, মনজুর আহমেদ ৬২ বছর সাংবাদিকতা করেছেন। সাংবাদিকতা তাঁর রক্তে, পাশাপাশি এও ঠিক যে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেছেন। তাঁর গ্রন্থ সংখ্যা ২১টি। এগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত মুক্তিযুদ্ধ, দ্বিতীয়ত স্মৃতিকথা, তৃতীয়ত তাঁর সাহিত্যকর্ম। তিনি গল্প, উপন্যাসও লিখেছেন। অমৃত পথযাত্রী তাঁর গুরুত্বপূর্ণ একটি বই।

হাসান ফেরদৌসের প্রশ্নের উত্তরে মনজুর আহমেদ বলেন, আমি যত জোর দিয়ে নিজেকে একজন সাংবাদিক বলতে পারি, তত জোর দিয়ে সাহিত্যিক বলতে পারি না। যে নিষ্ঠা আমার সাংবাদিকতায় আছে সে নিষ্ঠা সাহিত্য সাধনায় নেই। আমার পেশার পাশে যখন কোন ঘটনা প্রবাহ স্পর্শ করেছে তখন আমি কবিতা, গল্প, উপন্যাস লিখেছি। এটাকে সাহিত্য সাধনা বলা যায় না। তবে কিছু লেখা লিখে আমি অত্যন্ত আনন্দ পেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক তাঁর লেখা পাঁচটি গ্রন্থ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গ্রন্থ গুলোর বিষয়বস্ত একটি থেকে অন্যটি সম্পূর্ণ আলাদা। মুক্তিযুদ্ধের পর অনেক মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, সেগুলোর সংকলন প্রথম বইটা।

দেশের বাহির হতে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ করে এসেছেন, দেশে থেকে যারা সাফার করেছেন, নয় মাসের বিভিন্ন ঘটনাবলী, কোন কোন সেক্টরে কারা কীভাবে কাজ করেছেন, নৌ কমান্ডদের কথা সহ প্রতিটি বইয়ের প্রেক্ষাপট আলাদা। অজানার বঙ্গবন্ধু বইটি সম্পর্কে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পেয়েছি আমি খুব ছোটবেলা থেকে। তাঁকে আমি চাচা বলে সম্বোধন করতাম। খুব কাছে থেকে তাঁকে দেখেছি, জেনেছি। বইটি লিখতে পেরে খুব আনন্দ পেয়েছি।

শ্রোতাদের প্রশ্নের উত্তরে মনজুর আহমেদ বলেন, আত্মজীবনী লেখার কথা ভাবি নি, তবে আমি যে সময়টা দেখেছি সে সময়টা তুলে ধরা দায়িত্ব মনে করি। আমি প্রিয়, অপ্রিয়র মধ্যে বাস করি না। আমি হাড়ে মজ্জায় সাংবাদিক, সাদাকে সাদা বলি, কালোকে কালো বলি।

মনজুর আহমেদের সঙ্গে আলাপচারিতার সমাপ্তিতে আরেক বর্ষীয়ান সাংবাদিক মোহাম্মদ উল্লাহ বলেন, মনজুর আহমেদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব পাঁচ দশকের বেশি। মনজুর আহমেদ এবং আমি, বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে দুই ধরনের আদর্শে বিশ্বাস করি। মতের বিভেদ থাকা সত্ত্বেও একজন যে আরেকজনের সঙ্গে সভ্য, স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখতে পারে, আমাদের বন্ধুত্ব সেটি প্রমাণ করে। তাঁর বন্ধু হতে পেরে গর্ব বোধ করছি। আমি তাঁর দীর্ঘায়ু, সুস্বাস্থ্য কামনা করছি।

আসরের নিয়মিত আয়োজন দ্বিতীয় পর্বের প্রারম্ভে লেখক ফেরদৌস সাজেদীন বলেন, আপনাদের কারো চোখেমুখে কোন ক্লান্তি দেখছি না, দেখছি সবাই উদ্দীপ্ত হয়ে আছেন। উদ্দীপ্ত তো হবেনই, কারণ, আপনাদের সবার সঙ্গে রয়েছে আপনাদের নতুন সৃষ্টি কবিতা, গল্প, ছড়া। আপনাদের উল্লাস ভাগ করে নেয়ার জন্য সাহিত্য একাডেমি একটি পরিবেশ তৈরি করেছে, প্লাটফর্ম দিয়েছে, সেজন্য সাহিত্য একাডেমিকে ধন্যবাদ। মনজুর আহমেদের মতো প্রাজ্ঞজনরা নিয়ম করে সাহিত্য একাডেমিতে আসবেন, কথা বলবেন, আমরা আরো সমৃদ্ধ হবো সামনের দিনগুলোতে। সৃষ্টিশীলতা যার যার তার তার, কিন্তু সৃষ্টিশীলতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য একটা টোকা তো দরকার, সাহিত্য একাডেমি সেই কাজটাই করছে।

কবি তমিজ উদ্দিন লোদী বলেন, সাহিত্য একাডেমি সাহিত্যের নানান শাখায় কাজ করছে, এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের। নতুন প্রজন্ম সাহিত্য একাডেমিতে এসে স্বরচিত পাঠ করছে, এটি আমাদের জন্য আশা জাগানিয়া। বাংলা এবং ইংরেজি, এই দুটি ভাষায় যারা অভিজ্ঞ হবে তারাই আগামীতে আমাদের ডায়াসপোরা সাহিত্য সৃষ্টি করবে। সদ্য গত হওয়া পঞ্চাশ দশকের লেখক আবু বকর সিদ্দিককে তিনি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন, এবং তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করেন।

তিনি বলেন, আবু বকর সিদ্দিক যতটা শক্তিশালী লেখক ছিলেন ততটা তাঁর সম্পর্কে আলোচনা হয় নি আজ অবধি। এতে তাঁর কিছুই যাবে আসবে না। তিনি খুব নিকট ভবিষ্যতে শক্তিশালী লেখক হিসেবে বাংলা সাহিত্যে আরো বেশি করে আবিষ্কৃত হবেন। কবি কাজী আতীক বলেন, সাহিত্যের পুরো পরিবেশ বজায় রাখার জন্য সাহিত্য একাডেমির নিজস্ব জায়গা প্রয়োজন। এই বিষয়টি আমরা সকলে মিলে আরো গভীরভাবে চিন্তা করা জরুরি হয়ে উঠেছে। তিনি স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন।

লেখক নীরা কাদরী তাঁর পরিচালনায় কুইন্স পাবলিক লাইব্রেরীতে অনুষ্ঠিত লেখকের অঙ্গন সম্পর্কে বলেন, এখানে যাঁরা লিখছেন তাঁদের সম্মান জানানো, এবং একে অপরের বই পড়ে নিজস্ব মতামত তুলে ধরা লেখকের অঙ্গনের উদ্দেশ্য। পাঁচ মিনিট থেকে সাত মিনিটের বই আলোচনায় সবাই অংশগ্রহণ করতে পারবেন।

সাংবাদিক নিনি ওয়াহেদ বলেন, সাংবাদিকতা সূত্রে মনজুর আহমেদের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক থাকলেও আজ সাহিত্য একাডেমিতে এসে তাঁর মুখে অজানা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা শুনলাম। সাহিত্য একাডেমিকে ধন্যবাদ।

মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক মহসিন আলী বলেন, মনজুর আহমেদ সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জেনেছি, ভালো লাগছে। আশা করি সাহিত্য একাডেমি এমন নতুন নতুন আরো অনুষ্ঠান উপহার দিবে।
লেখক আবু সায়ীদ রতন বলেন, সাহিত্য একাডেমির নেয়া নতুন সংযোজন সাহিত্য একাডেমিকে আরো সমৃদ্ধ করবে, এবং এর প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাই।

লেখক আদনান সৈয়দ বলেন, সাহিত্য একাডেমির যে নতুন আয়োজন দেখছি, এতে সাহিত্য একাডেমি পূর্ণতা পাচ্ছে। বাংলা কিংবা ইংরেজি বইয়ের আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে বলেন, আগামী আসরে তিনি বই আলোচনায় অংশ নিবেন। তিনি মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ওরাল হিস্ট্রিগুলো লিপিবদ্ধ করা আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

আসরে আবৃত্তি করেন, নজরুল কবীর, ক্লারা রোজারিও, আনিস সিদ্দিকী ও মুনমুন সাহা। এবারের আসরে স্বরচিত পাঠ করেন, শামস আল মমীন, হোসাইন কবীর, এবিএম সালেহ উদ্দিন, স্বপন বিশ্বাস, তাহমিনা খান, বেনজির শিকদার, রিমি রুম্মান, জেবুন্নেসা জ্যোৎস্না, ফারহানা হোসেন, স্বপ্ন কুমার, এলি বড়ুয়া, আনোয়ার সেলিম, আলম সিদ্দিকী, রওশন সরকার, সুমা রোজারিও, সবিতা দাস, সুলতানা ফেরদৌসী, রুপা খানম, সীমু আফরোজা, রাজিনা চৌধুরী, নানজীব ইমাম চৌধুরী, পলি শাহীনা প্রমুখ।
আসরে উপস্থিত ছিলেন আবেদীন কাদের, আকবর হায়দার কিরণ, তাহমিনা শহীদ, রাহাত কাজী শিউলি, নাসির শিকদার, নীহার সিদ্দিকী, সেলিম আফসারী, লুৎফা শাহানা, রওশন হাসান, ফারজিন রাকিবা, শহীদ উদ্দিন, শাহনাজ হায়াত, এম.এ সাদেক, সৈয়দ মোহাম্মদ আলী, পারভীন পিয়া, নুসরাত কবীর, মিয়া এম আসকির, ইমাম চৌধুরী, স্বজন বণিক, মোজাম্মেল হক প্রমুখ।

অনুষ্ঠান শেষে মনজুর আহমেদের জন্মদিন উপলক্ষে আকবর হায়দার কিরণের সৌজন্যে সকলের উপস্থিতিতে কেক কাটা হয়। খবর প্রেস বিজ্ঞপ্তির।

সর্বশেষ