শিশুদের জন্য অনিরাপদ ফেসবুক, সিনেটে জাকারবার্গের ক্ষমা প্রার্থণা ও টাইম টেলিভিশনের একটি আলোচনা


প্রকাশিত: ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৬:০২
...
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে শিশুরা নানাবিধ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এমনকি আত্মহত্যায় প্ররোচিত হচ্ছে এমন অভিযোগের ভিত্তিতে বুধবার ইউএস সিনেটে হাজির করা হয়েছিলো পাঁচ শীর্ষ প্রযুক্তি কোম্পানিপ্রধানদের। তাদের সামনে নিয়েই শুনানি করলেন সিনেটররা। উপস্থিত ছিলেন ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের অভিভাবকদেরও অনেকে। সেখানে শুনানিতে এক উত্তপ্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়। যার এক পর্যায়ে অভিভাবকদের কাছে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হন সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকের প্যারেন্ট প্রতিষ্ঠান মেটার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মার্ক জাকারবার্গ।

অনলাইনে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয়ে বাড়তে থাকার উদ্বেগ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হাউস কমিটির সামনে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় তিনি এই ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ওয়াশিংটন স্টেটে এই শুনানি হয়। তাতে যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রতিনিধিরা অভিযোগ তোলেন, বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানি অনলাইনে যৌন হয়রানি থেকে শিশুদের রক্ষায় যথেষ্ট সক্রিয় হয়ে কাজ করছে না। এসময় তারা কমিউকেশন অ্যান্ড ডিসেন্সি অ্যাক্ট ১৯৯৬ এর আওতায় গৃহীত ইউনাইটেড স্টেটস কোড টাইটেল ৪৭ এর সেকশন ২৩০ সংশোধনের জোর দাবি জানান।

যুক্তরাষ্ট্রের ‘সিনেট জুডিশিয়ারি কমিটি’র এ শুনানিতে যোগ দেন সাবেক টুইটার বর্তমান এক্স-এর সিইও লিন্ডা ইয়াকারিনো, ডিসকর্ড প্রধান জেসন সাইট্রন ও স্ন্যাপচ্যাটের প্রধান ইভান স্পিগেল। শুনানিতে স্বেচ্ছায় সাক্ষ্য দিতে রাজি হন মেটার প্রধান মার্ক জাকারবার্গ ও টিকটকের প্রধান নির্বাহী শৌ জি চিউও।

শুনানি পর্বে প্যানেলের ডেমোক্র্যাটিক অংশের চেয়ারম্যান ডিক ডার্বিন ও রিপাবলিকান অংশের প্রধান লিন্ডজি গ্রেহাম তাদের যুক্তিতর্ক তুলে ধরেন। তারা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের মা-বাবা ও শিশুরা এ বিষয়ে পদক্ষেপ দেখতে চায়।

সামাজিক মাধ্যমগুলো কিশোর-কিশোরীদের যৌন হয়রানি থেকে রক্ষায় যথেষ্ট কাজ করছে না। এআই ব্যবহার করে তৈরি নকল ছবিসহ অনলাইনে শিশুদের নগ্ন ছবি তৈরি করে তা ভাইরাল করা হচ্ছে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

শুনানিতে চাপের মুখে ইনস্টাগ্রাম ও ফেসবুকের মালিক জাকারবার্গ সিনেটে তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে এহেন পরিস্থিতির জন্য ক্ষমতা চান। এবং উপস্থিত অভিভাবকদের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে কারও যাওয়া উচিত না’।

এ সময় তিনিসহ টিকটক, স্ন্যাপ, এক্স ও ডিসকর্ডের প্রধান কর্মকর্তাদের প্রায় চার ঘণ্টা ধরে উভয় পার্টির সিনেটররা জিজ্ঞাসাবাদ করেন। আইনপ্রণেতারা তাদের কাছে জানতে চান, অনলাইনে শিশুদের সুরক্ষার জন্য তারা কী করছেন? এ নিয়ে মেটা প্রধান জাকারবার্গকে সবচেয়ে বেশি জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়েন। সে সময় শ্রোতাদের দিকে ফিরে জাকারবার্গ বলেন, ‘আপনারা যা কিছুর মাঝ দিয়ে যাচ্ছেন, তার জন্য আমি দুঃখিত। এটি ভয়ানক। আপনাদের পরিবার যে যন্ত্রণার মাঝ দিয়ে গেছে, তার সম্মুখিন আর কোনো পরিবারের হওয়া উচিত নয়।’

এর আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কন্টেন্ট দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনেক কিশোর-কিশোরী আত্মহত্যা করছে বলে অভিযোগ তোলেন অভিভাবরা। শুনানির দিনেও তারা এ সংক্রান্ত বিভিন্ন অভিযোগ সামনে রেখেই সিনেটে হাজির হন। শুনানির পর অভিভাবকরা বিক্ষোভ করেন।

তবে এই শুনানি কিংবা সিনেটরদের যুক্তিতর্ক সত্যিকারের কোনো ফল বয়ে আনবে কি-না সে প্রশ্ন থেকেই যায়। কেউ কেউ একে রাজনীতির অংশ ও লোক দেখানো উপস্থাপনা বলতেও ছাড়েন নি। সোশ্যাল মিডিয়া বিশ্লেষক ম্যাট নাভারা বলেন, এই শুনানিটি অনেকটা শোডাউনের মতো, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন রাজনীতিবিদকে মুখর হতে দেখা গেছে আর দেখা গেছে মার্ক জাকারবার্গকে ক্ষমা চাইতে। মূল বিষয়ের চেয়ে মিডিয়ার জন্য এই ছবিগুলোই ছিলো গুরুত্বপূর্ণ বলেন এই বিশ্লেষক।

একই প্রশ্ন উঠেছিলো নিউইয়র্কে বাংলাদেশি কমিউনিটির প্রিয় টেলিভিশন চ্যানেল টাইম টিভির একটি টক শোতে। অন্য অনেক টেলিভিশনের মতো এই চ্যানেলটিরও দিনের আলোচ্য বিষয় ছিলো জাকারবার্গের ক্ষমা প্রার্থণা। তাতে অংশ নিয়ে আলোচকরা বলেন, সিনেট ফ্লোরে ঘটে যাওয়া এই ঘটনার পর সামাজিক মাধ্যমের প্ল্যাটফর্মগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু হবে এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। বিষয়টিতে উভয়পক্ষের সিনেটররা একমত হয়েছেন বটে, কিন্তু এরপর কী হবে, সেটা এখনো অস্পষ্ট রয়ে গেছে।

ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আতাউল করিম, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক হাসান ফেরদৌস, মেন্টাল হেলথ কাউন্সেলর শেহলা ইফতেখার ও সাংবাদকিক-শিক্ষক মাহমুদ মেনন এই আলোচনায় অংশ নেন।

আলোচকরা বলেন, আমরা এই শুনানি দেখছি কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, তারা এখন পর্যন্ত কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিতে পারে নি। এজন্য আলোচকরা সামনে আনেন কমিউকেশন অ্যান্ড ডিসেন্সি অ্যাক্ট ১৯৯৬ এর আওতায় গৃহীত ইউনাইটেড স্টেটস কোড টাইটেল ৪৭ এর সেকশন ২৩০। আলোচনায় অংশ নিয়ে তারা বলেন, যতক্ষণ এই ধারাটির পরিবর্তন না আনা হচ্ছে ততক্ষণে এই বিষয়ে কোনো সুরাহা আসবে না। এই ধারায় প্রশ্নাতীতভাবে এসব প্ল্যাটফর্মের কনটেন্টের দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেওয়া হয়েছে প্ল্যাটফর্মের মালিকদের। এবং তাদের কোনোভাবেই যে আইনের মুখোমুখি করা যাবে না, তাও নিশ্চিত করা হয়েছে এই ধারায়। ফলে, যত কথাই তারা বলুন না কেনো পরিবর্তন তখনই আসবে যখন ওই ধারার পরিবর্তন আসবে। বিষ্ময়কর হচ্ছে, যে সিনেটররা আজ উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলছেন, শুনানি করছেন, টাইটেল ৪৭ এর ধারা ২৩০ও তাদেরই হাতে তৈরি।

সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের কিছু কিছু দেশে যেসব কড়াকড়ি ও বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়, তার কিছুই যুক্তরাষ্ট্রে হয় না। অবাধ তথ্যপ্রবাহের নামে এর করুণ প্রভাব এখন শিশুদের উপর পড়ছে। ভবিষ্যত প্রজন্মকে রক্ষা করতে এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি বলেই মত দেন আলোচকরা।

তবে একই সঙ্গে পারিবারিক সচেতনতা, মূল্যবোধ সৃষ্টি সর্বোপরি সামাজিক মাধ্যম বাবহারে ব্যক্তি ও পরিবার পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ আরোপের ওপরও জোর দেন আলোচকরা।

সর্বশেষ