একই সুতোয় গাঁথা

ইমদাদুল হক মিলন
প্রকাশিত: ১৬ মার্চ ২০২৪, ২০:০৩
...

পৃথিবীর বহু বড় কবি-লেখক পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকে বেছে নিয়েছেন। প্রথম জীবনে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে সাংবাদিকতা করেছেন। ইউরোপ ও আমেরিকার লেখকদের মতো রুশ লেখকরাও অনেকেই ছিলেন এ পেশার সঙ্গে জড়িত। লেখকদের সঙ্গে সাংবাদিকতার পেশাটি সবচেয়ে মানানসই...

আমার একজন অতি প্রিয় লেখকের নাম শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। অনেক ঘাট পেরিয়ে তিনি এসে আনন্দবাজার পত্রিকায় যোগ দিলেন। যুক্ত হলেন কৃষিবিষয়ক সাংবাদিকতার সঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে বেড়াতেন। কৃষক ও কৃষিবিষয়ক নানা রকম সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে লেখালেখি করতেন। এটা ছিল তাঁর পেশার জায়গা। মূলত তিনি কথাসাহিত্যিক। অসামান্য সব গল্প-উপন্যাস লিখেছেন। বাংলা সাহিত্যে অতি সার্থকভাবে ম্যাজিক রিয়ালিজম যুক্ত করেছেন। তখনো পর্যন্ত জাদুবাস্তবতার গুরু বলা হয় যাঁকে, পৃথিবী কাঁপানো ল্যাটিন ঔপন্যাসিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস সেভাবে ভারতবর্ষে এসে পৌঁছাননি। বাঙালি পাঠক ঠিক জানেনও না জাদুবাস্তবতা বিষয়টা কী? শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখায় ওই জাদুটা অনেক পাঠক ধরতেই পারছিলেন না। মার্কেস পৌঁছাবার পর এক শ্রেণির মেধাবী বাঙালি পাঠক নতুন করে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে আবিষ্কার করলেন। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের জাদুবাস্তবতা অনুভব করলেন।
মার্কেস নিজেও সাংবাদিকতা করতেন। একটি জনপ্রিয় দৈনিকের সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন। সংবাদ সংগ্রহের কাজে কলম্বিয়ার গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছেন। ওই করতে গিয়ে গল্প-উপন্যাসের উপাদান পেয়ে গেছেন। সেই উপাদান নিয়ে গল্প-উপন্যাস লিখে পৃথিবী কাঁপিয়ে দিয়েছেন।

ঠিক এই কাজটিই করেছেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। কৃষিবিষয়ক সাংবাদিকতার কাজে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামগুলো চষে বেড়িয়েছেন। তাতে সাহিত্যের কাজটাও তাঁর হয়ে গেছে। কৃষিজীবী মানুষদের নিয়ে অপূর্ব সব গল্প লিখেছেন। যেমন-‘ধানকেউটে’, ‘চন্দনেশ্বরের মাচান তলায়’ অথবা ‘লক্ষ্মণ মিস্ত্রির জীবন ও সময়’। উপন্যাস লিখেছেন-‘স্বর্গের আগের স্টেশন’ অথবা ‘ঈশ্বরীতলার রূপকথা’। এসব লেখা বাংলা কথাসাহিত্যকে অনেকটা সমৃদ্ধ করেছে।

পৃথিবীর বহু বড় কবি-লেখক পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকে বেছে নিয়েছেন। প্রথম জীবনে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে সাংবাদিকতা করেছেন। ইউরোপ ও আমেরিকার লেখকদের মতো রুশ লেখকরাও অনেকেই ছিলেন এ পেশার সঙ্গে জড়িত। লেখকদের সঙ্গে সাংবাদিকতার পেশাটি সবচেয়ে মানানসই।

দূরের ইতিহাস না বলে বাংলা ভাষায় লেখকদের কথা বলি। পত্রিকায় কাজ করেছেন প্রায় সব বড় লেখক। মাঠে মাঠে হয়তো সবাই ঘোরেননি সংবাদ সংগ্রহের জন্য, সম্পাদনার কাজের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন অনেকেই। যেমন-মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত প্রমুখ। তারও পরে রমাপদ চৌধুরী, বিমল কর, সন্তোষকুমার ঘোষ, গৌরকিশোর ঘোষ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, মতি নন্দী, দিবেন্দু পালিত, জয় গোস্বামী-এ রকম অনেকে।

একসময় সাহিত্য ও সাংবাদিকতার ভাষা ছিল আলাদা। সাহিত্যের মেধাবী লেখকরা এসে দুটো ভাষা মিলিয়ে-মিশিয়ে একই বিন্দুতে নিয়ে এলেন। এ কাজটি শুরু হয়েছিল আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে। বাংলা ভাষার একজন খুব বড় সাহিত্যিক কাজটি করলেন। তাঁর নাম সন্তোষকুমার ঘোষ। তিনি আনন্দবাজার পত্রিকার ঊর্ধ্বতনদের একজন। অসামান্য সব উপন্যাস লিখেছেন। যেমন-‘কিনু গোয়ালার গলি’, ‘স্বয়ং নায়ক’, ‘সুধার শহর’ ও ‘শেষ নমস্কার-শ্রী চরনেষু মাকে’। এ উপন্যাসটির জন্য তিনি একাডেমি পুরস্কার পান। সাহিত্যের জগতে এ লেখক যেমন সমীহজাগানো, সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও তাই।

মতি নন্দী ছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকার ক্রীড়া সাংবাদিক। পরে ক্রীড়া সম্পাদক হন। লেখার জগৎ নিয়ে সাংবাদিকতা করেছেন সারা জীবন। সেই ফাঁকে গল্প-উপন্যাস লিখতেন। মতি নন্দী প্রথম বাঙালি লেখক, যিনি খেলাধুলাকে অত্যন্ত সার্থকভাবে সাহিত্যে তুলে আনলেন। কিশোরদের জন্য লিখলেন-‘স্টপার’, ‘স্ট্রাইকার’, ‘কোনি’ অথবা ‘ননীদা নট আউট’-এর মতো উপন্যাস। ‘দাদাশ বাকতি’ লিখলেন প্রাপ্তবয়স্ক পাঠকদের জন্য। বিষয় খেলার জগৎ। এর বাইরে লিখলেন অসামান্য কিছু- উপন্যাস। যেমন-‘নায়কের প্রবেশ ও প্রস্থান’, ‘কমলা কেমন আছে’, ‘বারান্দা’। নকশাল আন্দোলনের সময়কার কলকাতার শহর নিয়ে লিখলেন ‘শবাগার’-এর মতো অবিস্মরণীয় গল্প।

আমার অত্যন্ত প্রিয় লেখক জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী সংবাদপত্রকর্মী ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাসের নাম ‘বার ঘর এক উঠোন’ আর কত কত স্মরণীয় গল্প লিখে গেছেন এই লেখক। যেমন-‘শালিক কি চড়ুই’, ‘বনের রাজা’ অথবা ‘গিরগিটি’।

আনন্দবাজার পত্রিকায় পয়সার জন্য দুহাতে একসময় ফিচার লিখতেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। অন্যদিকে লিখেছেন কবিতা। তখনো গল্প-উপন্যাস লেখা শুরু করেননি। কয়েক বন্ধু মিলে কৃত্তিবাস বের করলেন। তার আগে সাগরময় ঘোষের অনুরোধে দেশ পত্রিকার পুজো সংখ্যায় লিখলেন প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’। কৃত্তিবাস পত্রিকায় একটি সংখ্যা প্রেসে আটকে আছে। ৪০০ টাকার জন্য পত্রিকা ছাড় করানো যাচ্ছে না। এক সিনেমা পত্রিকার সম্পাদক এসে বললেন, তাঁদের পুজো সংখ্যায় উপন্যাস লিখে দিলে ৪০০ টাকা দেবেন। প্রেস থেকে কৃত্তিবাস ছাড়ানোর জন্য সেই পত্রিকায় তিনি উপন্যাস লিখলেন। এটি তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস। নাম ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’। মহান সত্যজিৎ রায় এই উপন্যাসে চলচ্চিত্রায়ণ করলেন।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় প্রথম জীবনে শিক্ষকতা করতেন। তার পরে তিনি যুক্ত হলেন দেশ পত্রিকায়। সম্পাদনা বিভাগে কাজ করতেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় আনন্দবাজারের কর্মী। নানা রকম বিষয় নিয়ে লিখতেন। পরে শিশু-কিশোরদের পত্রিকা আনন্দমেলার সম্পাদকও হয়েছিলেন। তার আগে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ছিলেন ওই পত্রিকাটির সম্পাদক। গৌরকিশোর ঘোষ ‘সাগিনা মাহাতো’ নামে গল্প লিখে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। তিনি মূলত সাংবাদিক। সাংবাদিকতার জন্য র‌্যামন ম্যাগসেসাই পুরস্কার পেয়েছেন।

‘সাগিনা মাহাতো’ হিন্দিতে সিনেমা হয়েছে। অভিনয় করেছেন হিন্দি চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি দিলীপ কুমার। অসামান্য সব উপন্যাস আছে গৌরকিশোর ঘোষের। যেমন-‘জল পড়ে পাতা নড়ে’, ‘প্রতিবেশী’ ট্রিলজি অথবা ‘তলিয়ে যাবার আগে’। তাঁর একটি উপন্যাসের নাম বড় অদ্ভুত ‘কলকাতা এক প্রমোদ তরণী হা হা’। কিন্তু তিনি সম্মানিত হয়েছেন সাংবাদিক হিসেবে। বাংলা সাংবাদিকতার জগতে গৌরকিশোর ঘোষ এক কিংবদন্তির নাম।

এ রকম বহু উদাহরণ দেওয়া যায়।

বাংলাদেশের বেশির ভাগ কবি-লেখক সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, অনেকে এখনো আছেন। শামসুর রাহমান ছিলেন দৈনিক বাংলায়। পত্রিকাটির প্রধান সম্পাদক হয়েছিলেন। আহসান হাবীবও ছিলেন দৈনিক বাংলায়। আল মাহমুদ ছিলেন গণকণ্ঠ নামে একটি পত্রিকায়। হাসান হাফিজুর রহমান ছিলেন দৈনিক বাংলায়। রফিক আজাদ ছিলেন বাংলা একাডেমির উত্তরাধিকার পত্রিকায়। পরে যুক্ত হন সাপ্তাহিক রোববারে। তিনি আমাকে হাত ধরে যেমন সাহিত্যের জগতে এনেছিলেন, তাঁর হাত ধরে রোববার পত্রিকার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল আমার সাংবাদিকতার জীবন।

শহীদুল্লা কায়সারের ‘সংশপ্তক’ উপন্যাসের টেলিভিশন নাট্যরূপ দিয়েছিলাম আমি। এই লেখক যুক্ত ছিলেন দৈনিক সংবাদের সঙ্গে। তাঁর আরেকটি উপন্যাসের নাম ‘সারেং বউ’। আবদুল্লাহ আল মামুন চলচ্চিত্রায়ণ করেছিলেন।

লেখকদের জন্য সাংবাদিকতার পেশাটি বড় সহায়ক। কারণ সংবাদ সংগ্রহের কাজে ছুটে বেড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে চলমান সমাজের খুঁটিনাটি বহু কিছু লেখার অভিজ্ঞতা তার হয়। এ অভিজ্ঞতা সাহিত্যে অনেক কাজে লাগে। যাঁরা সম্পাদনা বিভাগের সঙ্গে যুক্ত থাকেন বা ফিচার বিভাগের দায়িত্বে থাকেন তাঁরাও প্রতিদিন নানা রকম অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। দেশ ও পৃথিবীর চেহারাটা তাঁদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। এ অভিজ্ঞতা তাঁরা কাজে লাগাতে পারেন সাহিত্যে। সুতরাং লেখকদের জন্য সাংবাদিকতার পেশাটি সবচেয়ে উপযুক্ত। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশের লোকদের ক্ষেত্রে। বিশ্বের উন্নত দেশের লেখকদের তো অন্য কোনো পেশার সঙ্গে যুক্ত হতেই হয় না। লেখাই হয়ে ওঠে তাঁদের পেশা। বছর-দুই বছরে একটি উপন্যাস লিখেই তাঁরা রাজার মতো জীবন কাটাতে পারেন। বড় বা জনপ্রিয় লেখকরা একটি উপন্যাসের জন্য যে পরিমাণ রয়ালটি পান বা যে পরিমাণ অ্যাডভান্স পান সেই টাকায় তাঁদের জীবন হয় রাজার জীবন। বিক্রম শেঠ নামে ইংরেজি ভাষায় এক ভারতীয় লেখক বিশাল আকৃতির এক উপন্যাস লিখলেন। উপন্যাসের নাম ‘এ সুইটেবল বয়’। বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হলো। ব্যাপক জনপ্রিয় হলেন লেখক। এক প্রকাশক ১০ লাখ ডলার অ্যাডভান্স দিলেন। ‘এ সুইটেবল গার্ল’ নামে পরবর্তী উপন্যাসটি লেখার জন্য। দুই বছর সময় দেওয়া হলো লেখককে। ওই সময়ের মধ্যে তিনি লিখতে পারলেন না। প্রকাশকের ১০ লাখ ডলার ফেরত দিলেন। বড় ভাষার জনপ্রিয় লেখকদের ক্ষেত্রে এসব সম্ভব। আমাদের পক্ষে কল্পনাতীত। আমাদের দেশে শুধু লেখালেখি করে জীবনধারণ প্রায় অসম্ভব। আমি একসময় চেষ্টা করে দেখেছি। পনেরো-কুড়ি বছর ও রকম লেখকজীবন কাটিয়েছিও। তারপর আর সম্ভব হয়নি। বাংলা ভাষার লেখকদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অন্যত্র রোজগারের ব্যবস্থা করে লেখালেখির কাজটা চালিয়ে যেতে হয়। সে ক্ষেত্রে সংবাদপত্রে যুক্ত হওয়াই সবচেয়ে নিরাপদ। লেখালেখির মধ্যেই থাকা যায়।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রধান সম্পাদক, কালের কণ্ঠ

সর্বশেষ