নির্বাচনকালীন সরকার: সমস্যা শুধু আন্তরিকতায়

আসিফ নজরুল 
প্রকাশিত: ১২ মে ২০২৩, ২০:০৫
...
আসিফ নজরুল 
নির্বাচন নিয়ে এ দেশে বিরোধ নতুন নয়। বিরোধের বড় অংশজুড়ে থাকে নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে, সে বিষয়টি। গত ৫০ বছরে কমবেশি এই বিতর্ক ছিল প্রতিটি আমলে।

নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বাংলাদেশে প্রথম বিতর্ক হয় দেশ স্বাধীনের বছরখানেকের মধ্যে। ১৯৭২ সালের সংবিধানে চতুর্থ তফসিলে নতুন নির্বাচন তৎকালীন সরকারের অধীন অনুষ্ঠানের বিধান করা হয়। এ নিয়ে গণপরিষদে আলোচনার সময় সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠিত না হওয়া পর্যন্ত একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের সুপারিশ করেন।

তিনি স্বাধীনতাসংগ্রামে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে এটি গঠনের প্রস্তাব দেন। তাঁর প্রস্তাব নাকচ করে তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন বলেন, নির্বাচনকালে আওয়ামী লীগ সরকার ‘কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট’ হিসেবে কাজ করবে। গণপরিষদে আওয়ামী লীগ নেতাদের পক্ষ থেকে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতিও ব্যক্ত করা হয়।

বাস্তবতা হচ্ছে, এরপরও ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত এ দেশের প্রথম জাতীয় নির্বাচন পুরোপুরি বিতর্কমুক্ত থাকেনি। এরপর দেশে বহু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, কমবেশি বিতর্ক হয়েছে সব নির্বাচন নিয়ে। নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে, এ নিয়ে তাই বিরোধের অবসান হয়নি কখনো।

২০১৪ ও ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীন নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগের পর দেশের আগামী নির্বাচন সামনে রেখে এই বিরোধ আবারও জোরালো হয়ে উঠেছে। বিএনপি, গণতন্ত্র মঞ্চ, বাম দলের জোটসহ বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীন নির্বাচন বর্জনের ডাক দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও তার জোটসঙ্গীরা দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন প্রশ্নে অনড়।

এর মধ্যে কয়েক দিন আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে নির্বাচনকালীন সরকারে দলটির অন্তর্ভুক্তি বিবেচনা করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন। বিএনপির মহাসচিব এই সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে এটি জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য ‘চক্রান্ত’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে আওয়ামী লীগ সম্পাদকের কথায় আস্থা রাখা বা বিশ্বাস করার প্রশ্নই উঠতে পারে না।

বিএনপির মহাসচিবের বক্তব্য কতটা গ্রহণযোগ্য, তার পক্ষে-বিপক্ষে বহু কিছু বলা যায়। কিন্তু এই বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই যে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। এই আলোচনার অবকাশও রয়েছে। নির্বাচন বর্জন বা একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের চিন্তার পাশাপাশি দুটি প্রধান দলেরই এসব বিবেচনা করে দেখা উচিত।

২.
নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার ফসল হিসেবে দেশে নির্বাচনকালে নির্দলীয় (অন্তর্বর্তীকালীন ও তত্ত্বাবধায়ক) সরকার প্রতিষ্ঠার বিধান করা হয়েছিল। এর ফলে ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সালে চারটি তুলনামূলক ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। প্রতিটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের পরাজয় ঘটেছিল এবং এটির সম্ভাবনা খারাপ কাজে ক্ষমতাসীনদের কিছুটা হলেও বিরত রাখতে পেরেছিল। ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিটির আলোচনাতেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলই তত্ত্বাবধায়ক সরকার অব্যাহত রাখার পক্ষে মতামত দিয়েছিল।

এখন এই সরকার ফিরিয়ে আনার পথে সংবিধান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের রায়ের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু সংবিধান একটি পরিবর্তনযোগ্য দলিল এবং দেশের প্রয়োজনে এমনকি আগে সম্পন্ন কাজকেও সংবিধান পরিবর্তন করে বৈধতা দেওয়ার নজির এ দেশে রয়েছে।

আর বিচারপতি হকের রায়ের কিছু বিভ্রান্তি এবং তা কীভাবে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করা হয়েছে, তা বদিউল আলম মজুমদার, প্রয়াত মিজানুর রহমান খান ও আমার নিজের কিছু লেখাতেও বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের প্রবল বিতর্কিত নির্বাচনের অভিজ্ঞতার আলোকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়টি তাই পুনর্বিবেচনার বাইরে থাকা উচিত নয়। তবে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে এর কোনো বিকল্প আছে কি না, তা-ও ভেবে দেখা যেতে পারে।

২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এমন সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে বিএনপির সদস্যদের নিয়োগ দিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার পুনর্গঠন করা যেতে পারে। এ প্রস্তাবে কতটা আন্তরিকতা ছিল, তা বিএনপির নাকচ মনোভাবের কারণে বোঝা যায়নি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এমন একটি ব্যবস্থায় নির্বাচনকালীন সরকারের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা সম্ভব কি?

আমরা সবাই জানি, বাংলাদেশের বর্তমান সরকারব্যবস্থায় সব ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে ন্যস্ত। একই সঙ্গে তিনি তাঁর রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং সংসদীয় দলের নেতা। তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে থেকে গেলে তাঁর সরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত পুলিশ বা প্রশাসন কর্মকর্তারা অন্য দলের মন্ত্রীর কথা শুনে নিরপেক্ষভাবে কাজ করবেন, এটা বিশ্বাস করা খুবই দুষ্কর।

আওয়ামী লীগ বা জাতীয় পার্টির অন্য কোনো সংসদ সদস্যকে (যেমন স্পিকার বা সংসদের বিরোধী দলের নেতা) নির্বাচনকালে প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন করে এই সমস্যা কিছুটা হলেও লাঘব করা সম্ভব। এমনকি প্রধানমন্ত্রী ও টেকনোক্র্যাট কোটায় বিএনপির কয়েকজন নেতাকে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী পদে নিয়োগ দেওয়া বর্তমান সংবিধান মোতাবেক অবশ্যই সম্ভব। এতে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রতি সুষ্ঠু নির্বাচনে বিশ্বাসী সব মহলের আস্থা বাড়ানোর সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে।

৩.
২০১৮ সালের নির্বাচনের (এবং এর পরের বিভিন্ন নির্বাচনে) পর দলীয় সরকারের অধীন সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব, এটি কোনো মানুষের বিশ্বাস করার কারণ নেই। এই সরকারের আমলে বর্তমান নির্বাচন কমিশন একাই সুষ্ঠু নির্বাচন করে ফেলতে পারবে, এমন কোনো বিশ্বাসযোগ্য আলামতও আমরা দেখতে পাইনি। কুমিল্লার উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের এমপিকে এলাকা ছাড়ার নির্দেশ বাস্তবায়নে ব্যর্থতা, বগুড়ায় হিরো আলমের অভিজ্ঞতা এবং সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে অনিয়মের ঘটনাগুলো এ ক্ষেত্রে নজির হিসেবে উল্লেখ করা যায়।

নির্বাচন সংস্কৃতিতে অনাস্থা সৃষ্টি করার মতো আরও ঘটনা গত কয়েক বছরে আমরা লক্ষ করেছি। সরকারের অপছন্দের ব্যক্তিদের প্রার্থিতা বিভিন্নভাবে বাতিল করা হয়েছে, প্রশ্নবিদ্ধ প্রক্রিয়ায় জাতীয় পার্টিকে অনুগত রাখার প্রচেষ্টা হয়েছে, অজস্র মামলা দিয়ে বিএনপি ও বিরোধী দলের নির্বাচনে অংশ নেওয়াকে প্রতিকূল বা অসম্ভব করে রাখা হয়েছে, পুলিশ ও প্রশাসন সুবিধামাফিক সাজানোর প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। বিভিন্ন জাতীয় নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণ লক্ষণীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। আমাদের মনে রাখতে হবে, নির্বাচন নিয়ে দেশে অনাস্থা ও হতাশার পরিস্থিতি অব্যাহত রাখলে জাতীয় ঐক্য, সংহতি এবং এর শক্তি আরও বিপর্যস্ত হবে। এর সুযোগ নেবে দেশ ও বিদেশের অশুভ শক্তি। দেশের সংসদে অরাজনৈতিক ও প্রশ্নবিদ্ধ ব্যক্তিদের প্রাধান্য, জবাবদিহিহীন লুটেরা অর্থনীতি ও বিদেশের সঙ্গে দেশের স্বার্থবিরোধী বিভিন্ন চুক্তির মধ্য দিয়ে আমরা এর বহু নজির দেখেছি।

এসব সমস্যা আগেও ছিল, ভবিষ্যতে সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও থাকতে পারে। কিন্তু বিতর্কিত নির্বাচনে বৈধতার সংকট প্রবল হয় বলে এভাবে ক্ষমতাসীনেরা টিকে থাকার জন্য দেশ-বিদেশের নানা শক্তির ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এটি অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।দেশের স্বার্থে আমাদের সবাইকে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত করার চেষ্টা করা উচিত। এমন নির্বাচন অনুষ্ঠানের উপায় রয়েছে। শুধু প্রয়োজন পরিশুদ্ধ নিয়তের।

আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক
সুত্র :  প্রথম আলো

সর্বশেষ