দেশে ৭৬ বছরের মধ্যে রেকর্ডভাঙা তাপপ্রবাহ

বাংলা পত্রিকা ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৮:০৪
...
এবার এই এপ্রিল মাসে টানা যত দিন তাপপ্রবাহ হয়েছে, তা গত ৭৬ বছরে হয়নি। গত বছর (২০২৩) একটানা ১৬ দিন তাপপ্রবাহ হয়েছিল। এবার তাপপ্রবাহ শুরু হয়েছে ১ এপ্রিল থেকে। আজ শুক্রবার ২৬ এপ্রিল, আজও তাপপ্রবাহ বইছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের কাছে একেবারে সুনির্দিষ্টভাবে ১৯৮১ সাল থেকে সর্বোচ্চ তাপপ্রবাহের উপাত্ত আছে। সেটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এর আগে ২০১০ সালে রাজশাহীতে সর্বোচ্চ ২০ দিন তাপপ্রবাহ ছিল, তবে তা টানা ছিল না। কিন্তু এবার টানা ২৬ দিন তাপপ্রবাহ হলো। আবহাওয়াবিদ ও বিশেষজ্ঞরা এমন প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের পেছনে চারটি কারণকে চিহ্নিত করেছেন। এবারের অতি তাপের কারণে এবার অতিরিক্ত জলীয় বাষ্প জমা হচ্ছে। আর তাতে চলতি বছর অতিবৃষ্টি হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন।

বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়ার যে মূল বৈশিষ্ট্য দেখা গিয়েছে, সেটা হলো অনিশ্চয়তা। প্রকৃতি কখন কীভাবে আচরণ করবে, তার ছন্দটাই নষ্ট হয়ে গেছে বা যাওয়ার পথে। এবার এত গরম হয়তো পরে দেখা যাবে, গরম একদম কমে গেছে। এই বিরূপ প্রকৃতিকে মোকাবিলা করাই এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ১৯৪৮ থেকে তাদের কাছে বিভিন্ন স্টেশনের আবহাওয়ার তথ্য-উপাত্ত আছে। তবে সব বছরে সব স্টেশনের উপাত্ত নেই। উপাত্তগুলো একেবারে সুনির্দিষ্টভাবে আছে ১৯৮১ সাল থেকে। তারপরও আগের স্টেশনগুলো বিশ্লেষণ করে আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, ১৯৪৮ থেকে চলতি বছর পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি তাপপ্রবাহ হয়েছে এবারের এপ্রিল মাসে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক দীর্ঘদিন ধরে তাপপ্রবাহ নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি বলেন, ‘১৯৪৮ সাল থেকে উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখেছি, এবারের মতো তাপপ্রবাহ টানা আগে হয়নি। বলা যায়, ৭৬ বছরের রেকর্ড এবার ভেঙে গেল।’

এবার টানা যেমন তাপপ্রবাহ হয়েছে, আবার এর বিস্তৃতিও বেশি ছিল। এ বছর দেশের ৭৫ ভাগ এলাকা দিয়ে টানা তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে, যা আগে কখনোই ছিল না। এমনটাই জানান আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. উমর ফারুক।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভান্ডারে থাকা ১৯৮১ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত তাপপ্রবাহের উপাত্ত অনুযায়ী, ২০১০ সালের এপ্রিলে রাজশাহীতে সবচেয়ে বেশি ২০ দিন মৃদু থেকে মাঝারি ও তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। কোনো একক মাসে এর আগে এত দিন ধরে তাপপ্রবাহ হয়নি। গত ৪৩ বছরের মধ্যে দেখা গেছে যশোরে তাপপ্রবাহের দিন সবচেয়ে বেশি। এরপরই আছে ঢাকা ও চুয়াডাঙ্গা।

১৯৮১ সাল থেকে সর্বোচ্চ তাপপ্রবাহের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এর আগে ২০১০ সালে রাজশাহীতে সর্বোচ্চ ২০ দিন তাপপ্রবাহ ছিল, তবে তা একটানা ছিল না। কিন্তু এবার টানা ২৬ দিন তাপপ্রবাহ হলো।
চার কারণে এত তাপ

আবহাওয়াবিদ, জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা এবারের তাপপ্রবাহের পেছনে চারটি কারণের কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলো হলো—উপমহাদেশীয় উচ্চ তাপ বলয়, শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত কমে যাওয়া, এল নিনোর সক্রিয়তা এবং বজ্রমেঘের কম সংখ্যা।

বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত আন্তসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) সঙ্গে যুক্ত। তিনি বলেন, চৈত্র মাসের শেষ থেকে দেশে গরম বাড়ে। বৈশাখ মাসজুড়েই এর প্রভাব থাকে। আসলে এবার বা সাম্প্রতিক সময়ে যে প্রচণ্ড তাপ, এর কারণ তো বৈশ্বিকভাবেই তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। তাপমাত্রা বৈশ্বিকভাবে ১ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশে।

এই যে তাপ, এটা পুরো উপমহাদেশজুড়েই বিস্তৃত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। সেখানে একটি অতিমাত্রার তাপবলয় তৈরি হয়েছে। যার প্রভাবে শুধু বাংলাদেশ নয় পশ্চিমবঙ্গসহ ভারত ও পাকিস্তানেও এবার তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বলে জানান অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম।

এখন যে তীব্র গরম পড়েছে, তা স্থানীয়ভাবে সৃষ্টি হওয়া কোনো মেঘের মাধ্যমে বৃষ্টি হলে কমবে না। বড় ধরনের বজ্রঝড়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। বড় তাপপ্রবাহের অঞ্চল ঢাকাসহ মধ্যাঞ্চল, খুলনা ও রাজশাহীর গরম বজ্রঝড়েই কমা সম্ভব।

আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, শৈলৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত কমে যাওয়া এবারের প্রচণ্ড গরমের একটি কারণ। পাহাড় বা পর্বতে বাধা পেয়ে বায়ু ওপরের দিকে উঠতে থাকলে তা তাপ কমিয়ে শীতল হতে থাকে। এর ফলে কোনো এক উচ্চতায় জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হয়ে মেঘের সৃষ্টি করে। আর এই মেঘ থেকে বৃষ্টি হয়।

আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, এ জন্য পর্বতের প্রতিবাত অঞ্চল বা উইন্ড অত্যধিক বৃষ্টি হয়। ভারতের আসাম, মেঘালয়, পশ্চিমঘাট পর্বত; বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, মিয়ানমারের আরাকান পর্বতে এ ধরনের বৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলের পাহাড়ের গায়ে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে এ বৃষ্টি বেশি হয়। কিন্তু এবার এর পরিমাণ একেবারেই কম। তাই গরমও অনেক বেশি।


এল নিনো মধ্য ও পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের দুটি বায়ুপ্রবাহের একটি। এল নিনো বলতে মূলত উষ্ণায়নের অবস্থা বোঝায়। অন্যদিকে লা নিনা বোঝায় এর উল্টো অবস্থাকে। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে এল নিনোর সক্রিয়তার কথা জানায়। এর কারণে যে এবার বিশ্বজুড়েই তাপপ্রবাহ বাড়েবে, তা আগে থেকেই সতর্ক করা হয়। অস্ট্রেলিয়া ব্যুরো অব মেটেরলজি এল নিনোর তথ্য জানায়। ১৬ এপ্রিল তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, এল নিনো শেষ হয়েছে।

আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান বলেন, এল নিনো পরিস্থিতি শেষ ঘোষিত হলেও এর রেশ রয়ে গেছে। তাই এবার এত তাপপ্রবাহ বেড়েছে।এ বছর এপ্রিল মাসে মাত্র একটি বড় কালবৈশাখী হয়েছে। গত বছরও এর সংখ্যা ছিল সাতটি। বজ্রমেঘ সৃষ্টি হয়ে কালবৈশাখী বৃষ্টি ও ঝোড়ো হাওয়া তৈরি করে। এর জন্য ভারতের বিহার, ওডিশা ও পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকায় সৃষ্টি হওয়া স্কোয়েল বা ঝড়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু এবার এর লক্ষ্মণ এখনো দেখা যাচ্ছে না।

এবার টানা যেমন তাপপ্রবাহ হয়েছে, আবার এর বিস্তৃতিও বেশি ছিল। এ বছর দেশের ৭৫ ভাগ এলাকা দিয়ে টানা তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে, যা আগে কখনোই ছিল না।
আগামী দিনের শঙ্কাঅস্ট্রেলিয়ার আবহাওয়া দপ্তর এল নিনোর সমাপ্তির কথা ঘোষণার পাশাপাশি লা নিনার আগমনের কথা জানিয়েছে।

অধ্যাপক সাইফুল ইসলামের বক্তব্য, লা নিনার সক্রিয় হয়ে ওঠার অর্থ হলো, এবার বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত বৃষ্টি হতে পারে। কারণ, সমুদ্র তো বটেই, ভূপৃষ্ঠেও জমা হয়ে আছে এখন তৈরি হওয়া অতিরিক্ত তাপ। এতে প্রচুর জলীয় বাষ্প তৈরি হবে আর বৃষ্টি ঝরবে বেশি।

১৫ এপ্রিল ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর বলেছে, এবার স্বাভাবিকের চেয়ে বর্ষা মৌসুমে বেশি বৃষ্টি হতে পারে। বলা হয়েছে, এবার ভারতের তামিলনাড়ু, উত্তর প্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের বড় অংশে অস্বাভাবিক বৃষ্টি হতে পারে। এবার এসব অঞ্চলে দীর্ঘদিনের স্বাভাবিক বৃষ্টির চেয়ে ১০৬ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হতে পারে।

আবহাওয়াবিদ মো. শাহীনুল ইসলাম বলছিলেন, ‘এখন যে প্রচণ্ড গরম পড়েছে, তা স্থানীয়ভাবে সৃষ্টি হওয়া কোনো মেঘের মাধ্যমে বৃষ্টি হলে কমবে না। বড় ধরনের বজ্রঝড়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। দেশের সবচেয়ে বড় তাপপ্রবাহের অঞ্চল ঢাকাসহ মধ্যাঞ্চল, খুলনা ও রাজশাহীর গরম বজ্রঝড়েই কমা সম্ভব।’

সর্বশেষ